কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকাহ ভূমিকা মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত্তুওয়াইজিরী ১ টি

নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই। আমরা তারই প্রশংসা করি, তারই নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমাদের প্রবৃত্তির অনীষ্ট ও মন্দ কার্যাদি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দান করেন তার ভ্রষ্টকারী কেউ নেই আর তিনি যাকে ভ্রষ্ট করেন তার হেদায়েতকারী কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। যিনি একক, তাঁর কোন শরিক নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রসূল।

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ حَقَّ تُقٰتِهٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ﴿۱۰۲﴾

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। আর অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’’ [সূরা আল-ইমরান:১০২]

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَ بَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡ تَسَآءَلُوۡنَ بِهٖ وَ الۡاَرۡحَامَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلَیۡکُمۡ رَقِیۡبًا ﴿۱﴾

‘‘হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট চেয়ে থাক এবং আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।’’ [সূরা নিসা:১]

 

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ قُوۡلُوۡا قَوۡلًا سَدِیۡدًا ﴿ۙ۷۰﴾ یُّصۡلِحۡ لَکُمۡ اَعۡمَالَکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ فَقَدۡ فَازَ فَوۡزًا عَظِیۡمًا ﴿۷۱﴾


‘‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে।’’ [সূরা আহজাব:৭০-৭১]


অতঃপর সর্বোত্তম হাদীস (বাণী) হলো আল্লাহর কিতাব এবং কল্যাণময় হেদায়েত হলো মুহাম্মদ (সা.)-এর হেদায়েত। আর সবচেয়ে অনীষ্টকর বিষয় হলো (ধর্মের নামে) নব আবিস্কৃত জিনিস এবং প্রতিটি নব আবিস্কৃত জিনিসই হলো বিদ‘আত। আর প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা এবং প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিনাম জাহান্নাম।

সম্মানিত মুসলিম ভাই!

নিঃসন্দেহে দ্বীনের ফিকাহ তথা সঠিক সূক্ষ বুঝ এক উত্তম, পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ জ্ঞান। ইহা আল্লাহর নামসমূহ, গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য, তাঁর কার্যাদি এবং দ্বীন ও শরীয়তকে জানা। এ ছাড়া তাঁর নবী-রসূলগণ (আ:) কে জানা এবং ঈমান-আকীদায়, কথা-কাজে এবং চলাফেরা ও চরিত্রে সে মোতাবেক আমল করা। নিঃসন্দেহে জ্ঞানের চূড়ান্ত হলো আল্লাহর তাওহীদকে জানা এবং আমলের চূড়ান্ত হচ্ছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করা। আর ইহাই হলো আল্লাহর সবকিছু সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তাঁর শরিয়তের সমস্ত কল্যাণের সমন্বয়কারী।
 

মু‘আবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (সা.) বলেছেনঃ

‘‘আল্লাহ যে ব্যক্তির কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের ফিকাহ তথা সঠিক সূক্ষ্ণ বুঝ দান করেন।’’[1]

এ কথা সন্দেহাতিত, যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ তা‘য়ার প্রতি ঈমান আনবে ও তাঁর মহাবাণী আল-কুরআনের আনুগত্য করবে এবং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ পালন করবে, সেই তাঁর বিরাট সওয়াব অর্জন করবে। এ ছাড়া আরো সত্য কথা হলো, যে ব্যক্তি দুনিয়ার জ্ঞানের জান্নাতে প্রবেশ করবে সেই আখেরাতের সজ্জিত জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহ তা‘য়ালা তার প্রতি সন্তুষ্টি হবেন এবং তাকে সন্তুষ্টি করাবেন যেমন সে আল্লাহকে তাঁর আনুগত্যের দ্বারা রাজি করিয়েছে।

আর যে তার প্রতিপালকের প্রিয় জিনিসসমূহ পূর্ণ করে আল্লাহ তার পছন্দ জিনিসসমূহ আখেরাতে পূর্ণ করবেন। আর যে তার নফসকে অজ্ঞতা এবং প্রবৃত্তির কারাগারে বন্দী করবে আল্লাহ তা‘য়ালা তাকে কিয়ামতে জাহান্নামের কারাগারে বন্দী করবেন। এ ছাড়া সে যেভাবে আল্লাহ তা‘য়ালার নাফরমানি করে তাঁকে নারাজ করিয়েছে অনুরূপ তিনিও তার প্রতি নারাজ হবেন।


(বইটি লিখার কারণ)

একজন মু‘মিন অপর মু‘মিনের জন্য একটি দালান ঘরের মত, যার একটি অংশ অপর অংশকে মজবুত করে। বর্তমানে শিরক ও অজ্ঞতার কালো অন্ধকার সুপ্রসারিত এবং সাধারণ মানুষের মাঝে বিদ‘আত ও নাফরমানির ছড়াছড়ি। আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধের দায়িত্ব পালনার্থে এবং নিজেকে ও ভাইদেরকে স্মরণ করার নিমিত্বে এ কাজের অবতরণা।


 (কিতাবটি লিখার উদ্দেশ্য)

আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে এই কিতাবের দ্বারা জ্ঞান পিপাসুদের দ্বীনের ফিকাহ শিখানো, অজ্ঞদের জ্ঞান দান করা, গাফেল তথা উদাসীনদের স্মরণ করিয়ে দেয়া, পাপীদের তওবার সুযোগ করে দেয়া, পথভ্রষ্টদের হেদায়েত পাওয়া ও নিষ্ঠুরদের অন্তরে পরশের সুযোগ করে দেয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য।

ইহা উল্লেখিত কারণসমূহের জন্য দায়িত্ব মনে করে এবং আমার প্রতি আল্লাহর নেয়ামতসমূহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ মাত্র। এ ছাড়া আমার ভাইদের সাথে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার এবং দা‘ওয়াদের কাজে শরিক হওয়া একান্ত জরুরি মনে করেছি।  

আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর অনুকম্পা, অনুগ্রহ, তওফিক ও সাহায্যের দ্বারা এ কিতাবটি লিখা আমার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এ কিতাবটি প্রস্ত্তত ও বিন্যাস বিভিন্ন ধরনের নির্ভরযোগ্য ইসলামী কিতাব হতে নেয়া হয়েছে। এতে তাওহীদ, ঈমান, আদব-আখলাক, জিকির-আজকার, দোয়া ও প্রয়োজনীয় আহকাম ----- ইত্যাদি বিষয় জমা করা হয়েছে।

আল্লাহর বিশেষ মেহেরবাণী ও অনুকম্পায় কিতাবটিতে কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীস সমন্বিত এক সমাহার ঘটেছে। আর ‘‘ফুরু‘ঈ মাসায়েল’’ তথা দ্বীনের মৌলিক বিষয় ছাড়া শাখা-প্রশাখার ফিকাহ বিষয়ে শুধুমাত্র একটি মত উল্লেখ করেছি।  আল্লাহর নিকট আশা পোষণ করি যে, ইহাই সঠিক মত। যার ফলে হক তথা সঠিক দ্বীন অনুসন্ধানীরা বিশেষ করে নবীণ জ্ঞান পিপাসুরা অতি সহজে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে।

কিতাবটি অতি সংক্ষিপ্ত ও সহজভাবে পেশ করা হয়েছে, যাতে করে উলামাগণ ও নবীণরা অল্প সময়ে এবং কষ্ট ছাড়াই উপকৃত হতে পারেন। কিতাবটি একমাত্র আল্লাহর ফজল ও করমে এক জ্ঞান ভান্ডারে পরিণত হয়েছে, যা বহন করতে হালকা ও আকারে মধ্যম।

কিতাবটি থেকে ইবাদতকারী তার ইবাদতে, বক্তা তার ওয়াজ-নসিহতে, মুফতী সাহেব তার ফতোয়া দানে, শিক্ষক তার শিক্ষকতায়, কাজি তথা বিচারক তার বিচার-আচারে, ব্যবসায়ী তার লেনদেনে, দ্বীনের আহবানকারী তার দা‘ওয়াতে ও সাধারণ মুসলিম তার প্রতিটি অবস্থাতে উপকৃত হবেন।

কিতাবটির সাধারণ মূলনীতিমালাগুলো এবং ফুরু‘ঈ তথা শাখা-প্রশাখার মাসায়েলসমূহ ফিকাহ শাস্ত্রের ছোট-বড় নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন কিতাবসমূহ থেকে গ্রহণ করেছি। এর পাশাপাশি অতীত ও বর্তমানের উচ্চ পর্যায়ের উলামাগণের ফতোয়াসমূহ থেকেও গ্রহণ করেছি। আর মহামতি চতুষ্টদয় ইমামগণ: ইমান আবু হানীফা রহ: (মৃত: ১৫০ হি:), ইমাম মালেক রহ: (মৃত:১৭৯ হি:), ইমাম শাফে‘য়ী রহ: (মৃত:২০৪ হি:) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহ: (মৃত:২৪১ হি:) ও অন্যান্য ইমামগণের কুরআন ও সহীহ হাদীসের শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে সঠিক মতের উপর নির্ভর করেছি।

কিতাবটির তাওহীদ, ঈমান ও আহকাম ইত্যাদির অধ্যায়সমূহে চেষ্টা করেছি যেন, প্রতিটি মাসলা-মাসায়েল কুরআন ও সহীহ হাদীসের উভয়টি অথবা কোন একটির ভিত্তিতে হয়। আর যে সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীস থেকে সুস্পষ্ট কোন সহীহ দলিল উল্লেখ হয়নি সে ব্যাপারে অতীত-বর্তমানের মুজতাহেদ[2] উলামাগণের বাণী ও নির্ভরযোগ্য মতের উপর নির্ভর করেছি।

তাওহীদ, ঈমান, জ্ঞানার্জন, ফাজায়েল, চরিত্র, ইসলামী আদব, জিকির-আজকার ও দোয়ার অধ্যায়গুলোতে শরিয়তের সহীহ দলিলসমূহের সমাহার ঘটিয়েছি; কারণ এগুলো প্রতিটি মুসলিমের বিশেষ প্রয়োজন।

আর ফুরু‘য়ী (শাখা-প্রশাখার) ফিক্হের অধ্যায়গুলোতে শুধুমাত্র হুকুম বর্ণনা করেছি, সেখানে দলিল ও কারণ বর্ণনা করা হয়নি; কেননা এর ফলে কিতবের কলেবর ও মাসায়েলের শাখা-প্রশাখা বেড়ে যাবে। এ ছাড়া যে উদ্দেশ্যে কিতাবটি লিখা হয়েছে তার পরিপন্থী হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি শরিয়তের দলিলসমূহ বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক তিনি যেন, বড় বড় ফিকাহর মূল কিতাবসমূহে তালাশ করেন। যেমন: মুগনী, মাজমু‘য়া ফতোয়া, উম, মাবসূত, মুদাওয়ানাহ ইত্যাদি ফিকাহ ও হাদীস গ্রন্থসমূহ।

আর যে ব্যক্তি অন্তরের আমলসমূহের কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিস্তারিতভাবে জানতে ইচ্ছুক সে যেন আমাদের লেখা সুপরিসর গ্রন্থ ‘‘মাওসূ‘য়া ফিকহিল কুলূব’’ (৫ খন্ডে) অধ্যায়ন করেন। এ ছাড়া যে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তাওহীদ, ঈমান এবং শরিয়তের বিধানসমূহের বিস্তারিত জ্ঞানার্জন করতে চান তিনি যেন আমাদের লেখা কিতাব ‘‘মাওসূ‘য়াতুল ফিকহিল ইসলামী’’ ৫ খন্ডে পড়েন।

কখনো আবার শাখা-প্রশাখার মাসায়েলের দলিল উল্লেখ করেছি; মাসয়ালাটির বিশেষ গুরুত্বের জন্য অথবা তা বেশি বেশি সংঘটিত হয় বলে কিংবা উৎসাহ প্রদানের উদ্দেশ্যে বা তা থেকে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের  জন্যে।

কিতাবটির ইলমী তথা জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়বস্ত্ত দু’টি মহান মূলের উপর নির্ভরশীল। তা হলো উম্মতের সালাফে সালেহীনগণের বুঝে কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসসমূহ। প্রতিটি আয়াতের নম্বরসহ সূরার নাম গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করতে সচেষ্ট হয়েছি। আর নবী (সা.)-এর হাদীসসমূহ হতে শুধুমাত্র সহীহ হাদীস[3] অথবা হাসান হাদীস[4] উল্লেখ করেছি। সাথে সাথে প্রতিটি হাদীসের মূল হাদীস গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি। এ ছাড়া প্রতিটি হাদীস সহীহ কিংবা হাসান তার হুকুম সহকারে নিম্নে বর্ণিত পন্থা অবলম্বন করেছি:

এ কিতাবে উল্লেখিত সমস্ত হাদীসগুলো হারাকাতসহ (স্বরবর্ণ ও স্বরধ্বনি যুক্তসহ) মূল হাদীসের কিতাবসমূহ থেকে নেয়া হয়েছে।

হাদীস যদি সহীহাইন (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)-এর কিংবা কোন একটির হয়, তাহলে প্রতিটির হাদীস নম্বরসহ উল্লেখ করেছি। আবার কখনো বিশেষ উপকার বা শব্দ বেশি হওয়ার কারণে একটির সাথে হাদীসের অন্য কোন কিতাবের নামও উল্লেখ করেছি।

যদি হাদীস সহীহাইনের বাইরের হয় যেমন: মুসনাদে আহমাদ, চারটি সুনান গ্রন্থ, (সুনানে নাসাঈ, সুনানে আবু দাঊদ, সুনানে তিরমিযী ও সুনানে ইবনে মাজাহ) ও সুনানে দারেমী ইত্যাদি হাদীসের কিতাবসমূহ, তাহলে দু’টি কিতাবের নাম উল্লেখ করেছি। আবার কখনো এর কম-বেশিও হয়েছে। এর সাথে হাদীসের আসল কিতাবের হাদীস নম্বর উল্লেখ করেছি।

হাদীসের তাখরীজে তথা রেফারেন্স বর্ণনায় মূল কিতাবের হাদীস নম্বরের উপর নির্ভর করেছি। আর আসল কিতাবে কোন নম্বর না থাকলে খন্ড ও পৃষ্ঠা নং উল্লেখ করেছি।

যদি হাদীস সহীহাইনের বাইরের হয়, তাহলে হাদীস তাখরীজ তথা রেফারেন্স উল্লেখের সময় প্রতিটি হাদীসের সহীহ বা হাসান হুকুমসহ তার সামনে (হাদীসটি সহীহ কিংবা হাসান) লিখেছি। আর এ ব্যাপারে পূর্বের ও পরের অভিজ্ঞ ইমামগণের মতামতের উপর নির্ভর করেছি।

যদি কোন হাদীস অন্যত্র দ্বিতীয়বার উল্লেখ হয় তাহলে অনেক ক্ষেত্রে আবারও তার তাখরীজ (রেফারেন্স উল্লেখ) করা হয়েছে। আর কখনো কোন হুকুম বর্ণনা বা তারগীব তথা উৎসাহ প্রদান অথবা তারহীব তথা ভয়প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তার সাথে কোন সহীহ হাদীস বা হাদীসের কোন অংশা সংযুক্ত ক’রে দিয়েছি।

আমাদের সামনে এ কিতাবটি ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম, আদব-আখলাক সম্পর্কে সাধারণ পরিচিতি মাত্র। এতে বিক্ষিপ্ত বিষয়গুলো একত্রিত করেছি এবং তার অধ্যায়, মাসায়েল ও দলিলসমূহ একটি অপটির সাথে সুন্দর করে সঙ্কলন করেছি।

এ কিতাবটির নাম রেখেছি ‘‘মুখতাসার আল-ফিকহ্ আল-ইসলামী ফী যাওয়িল কুরআনি ওয়াস্সুন্নাহ’’ (কুরআন ও সুন্নাহ-এর আলোকে সংক্ষিপ্ত ইসলামী ফিকাহ্)। এর প্রথমভাগে উল্লেখ হয়েছে তাওহীদ ও ঈমান ও মধ্যম ভাগে বিভিন্ন সুন্নত ও হুকুম-আহকাম আর শেষভাগে দা‘ওয়াত ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর দিকে মানুষকে দা‘ওয়াত।

কিতাবটি ১০টি পর্বে নিম্নে বর্ণিত পদ্ধতিতে সুবিন্যাস্ত করেছি:

  • প্রথম পর্ব: তাওহীদ ও ঈমান।
  • দ্বিতীয় পর্ব: ফাজায়েল, আদব-আখলাক, জিকির-আজকার ও  দোয়াসমূহে কুরআন-সুন্নাহর ফিকাহ্।
  • তৃতীয় পর্ব: ইবাদত সংক্রান্ত।
  • চতুর্থ পর্ব: লেনদেন ও আদান-প্রদান সম্পর্কে।
  • পঞ্চম পর্ব: বিবাহ ও তৎ সংশ্লীষ্ট বিষয়াদি।
  • ষষ্ঠ পর্ব: কিতাবুল ফারায়েজ তথা সম্পত্তির উত্তরাধিকার বণ্টন নীতিমালা।
  • সপ্তম পর্ব: শাস্তি ও দন্ডবিধি।
  • অষ্টম পর্ব: ফয়সালা তথা বিচার-আচারের নীতিমালা।
  • নবম পর্ব: জিহাদের আহকাম।
  • দশম পর্ব: আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াতের আহকাম।

এ কিতাবটির উদ্দেশ্য হলো প্রতিপালক মহান উপাস্য আল্লাহ তা‘য়ালাকে জানা এবং দ্বীনের আহকামের বর্ণনা করা। আর সারা বিশ্বের জনগণের জীবনের প্রতিটি বিভাগে আল্লাহর নির্দেশাবলির জীবিতকরণ। এ ছাড়া মানুষকে সীরাতে মুস্তাতীম আঁকড়িয়ে ধরার প্রতি উৎসাহিত করা।

আর আল্লাহর অনুগ্রহে এ প্রশস্ত ফিকাহর পাত্রটি প্রস্ত্তত হয়েছে যা থেকে নেওয়া খুবই সহজ; কারণ এর ফলের থোকাগুলো অতি নিকটে এবং শব্দসমূহ সুন্দর, পর্যাপ্ত অর্থবহ ও বাক্যসমূহ সংক্ষিপ্ত।

ইহা কোন প্রকার কষ্ট, বিরক্তি ও ক্লান্তি ছাড়াই তার তালাশকারীর প্রয়োজন পূর্ণ এবং উদ্দেশ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে।

ইহা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের দিকে অন্তরসমূকে নড়াদানকারী, বিস্ময়কর উপকারিতার সমাহার, পাঠক ও শ্রোতার জন্য আরামদায়ক এবং নীরব সঙ্কল্পকে জান্নাতের উদ্যানসমূহেরপানে উদ্দীপক।

ইহা ঈমানদার অন্তরসমূহের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, ফেটে যাওয়া ঘা'গুলোর চিকিৎসা করে, ব্যথার জ্বালা-যন্ত্রণাকে আরাম দেয়, সকল প্রকার বিদ‘আত ও অজ্ঞতাকে বিতাড়িত করে এবং প্রত্যেক প্রতাপশালী, মুনাফেক ও অবাধ্যদেরকে দমন করে।

আমি একত্রিত ও প্রস্ত্তত করেছি যাতে করে ইহা আল্লাহর মখলুকাত সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপায়, বাড়িতে অবস্থানকারীর জন্য সঙ্গী এবং মুসাফিরের জন্য পাথেয়, নিঃসঙ্গতার পরম বন্ধু, পরিবারের জন্য উদ্যান এবং উম্মতের জন্য ভোজসভা স্বরূপ হয়। আর আল্লাহর ফজল ও করমে কুরআন ও সুন্না্হ, বর্ণিত ও যুক্তিসঙ্গত এবং উৎসাহ ও ভয় প্রদর্শনের মাঝে জমাকারী এ মেঘ মালার সমারোহ ঘটেছে।

এর পাঠকারী দাওহীদ ও শরিয়তের গগনে সাঁতার কাটবে, সত্য, সুন্নাহ ও মর্যদাকে নির্ধারন করবে এবং শিরক, বিদ‘আত ও নিকৃষ্টকে ধ্বংস করবে।

আল্লাহর নিকট আকুল আবেদন এই যে, একে তাওহীদপন্থীদের জন্য চক্ষু শীতলকারী, ইবাদতকারীদের জন্য প্রদীপ, দ্বীনের আহবানকারী ও শিক্ষক মন্ডলীদের জন্য পাথেয়, তওবাকারীদের জন্য আলোকস্তম্ভ এবং পথচারীদের জন্য জ্যোতি বানিয়ে দেন।


প্রিয় মুসলিম ভাই!

আপনার জন্য এই পুস্পে পল্লবীত উদ্যান, যার ফল পেকে গেছে ও গাছসমূহ তার শীতল ছায়া দেয়া শুরু করেছে। এ কিতাবটি আমার প্রতি আল্লাহর শুধুমাত্র অনুকম্পা ও কৃপা ও দয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এর মধ্যে যে সমস্ত সঠিক উল্লেখ হয়েছে তা একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যেসব ভুল-ভ্রান্তি ঘটেছে তা আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে। জিভের যেখানে স্খলন ঘটেছে অথবা ভুল ও ভ্রম হয়েছে তা থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রত্যেক সঙ্কলক ও প্রনেতা-লেখক কঠিন সাবধানতা ও যাচাই-বাছাই, গভীর দৃষ্টি এবং গবেষণা করার পরেও পদস্খলন ও ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মাসায়েল ও অধ্যায় এবং সংক্ষেপণ ও বিশ্লেষণ করতে গিয়েও অনীচ্ছাকৃতভাবে ভুল হয়ে যায়। বিশেষ করে এ ফেতনার যুগে খুব কম লেখকই আছেন যার মন-মস্তিস্ক সুস্থ থাকতে পারে; কেননা ব্যস্ততা অধিক, সমস্যা নানাবিধ, অস্থির ও বিঘ্নীতকর বিষয়ের হামলা এবং একাধারে বালা-মসিবত ও পেরেশানি। প্রত্যেক বনি আদম ভুল করে আর উত্তম ভুলকারী যারা তওবা করে। আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করছি।

কলম শরিয়তের আজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ন্যায় ভুল করে ও সঠিকও করে এবং আরম্ভ করে ও ফিরেও আসে। আর এমন কোন অঙ্গুলি নেই যার স্খলন ঘটে না এবং এমন কোন স্মরণশক্তি নেই যার ভ্রান্তি হয় না।

অতএব, ঐ মুসলিম ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর দয়া যিনি এ কিতাবের মাঝে সঠিক দেখে আল্লাহর শোকর করবেন এবং কোন প্রকার ভুল-ত্রুটি দেখলে পরামর্শ দিবেন। তিনি একজন আমানতদার কল্যাণকামী এবং সত্যবাদী হেকিম যিনি ঐ সমস্ত জখমের চিকিৎসা করেন যা হতে কম সংখ্যক মানুষই নিরাপদে থাকেন। তিনি হাড়গোড় ভাঙ্গেন না এবং বিশেষ ও সাধারণের মাঝে ফেতনার বীজও বপন করেন না।

আর এ মহান দ্বীন যে তার দ্বারা আমল করবে, তার প্রতি দাওয়াত করবে, তার পক্ষ থেকে প্রতিহত করবে এবং এর জন্য ধৈর্যধারণ করবে তার কোন সন্দেহ থাকবে না।

পরিশেষে আল্লাহর নিকট দোয়া করি তিনি যেন এ কিতাবটি দ্বারা আমাকে ও সকল মুসলিম ভাইদেরকে উপকৃত করেন। আর ইহা আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর সস্ত্তষ্টচিত্তে কবুল করে নেন। আমাকে ও আমার পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজন, প্রত্যেক সুধি পাঠক-পাঠিকা, শ্রোতামন্ডলী, প্রত্যেক উপকৃত ব্যক্তি, যাঁরা এর শিক্ষা দানকারী অথবা প্রচার-প্রসারে সাহায্যকারী এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করেন ও ভুল-ত্রুটি মাফ করে দেন।


আল্লাহই একমাত্র আমাদের জন্য যথেষ্ট ও তিনিই উত্তম প্রতিনিধি। তিনিই উত্তম মাওলা তথা বন্ধু ও উত্তম সাহায্যকারী।


লিখেছেন

মহান রবের ক্ষমাভিখারী
মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে আব্দুল্লাহ আত্তুওয়াইজিরী
আল-বুরাইদাহ, আল-কাসীম, সৌদি আরব।

মোবাইল:০৫০৮০১৩২২২-০৫০৪৯৫৩৩৩২
Mb_twj@hotmail.com


ত্রয়োদশ সংস্করণ

১৪৩২হি: ২০১১ইং

[1] বুখারী হাঃ নং ৭১ মুসলিম হাঃ নং ১০৩৭

[2] মুজতাহেদ হলেন: দ্বীনের মাসলা-মাসায়েল কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে নির্ধারণ করার বিশেষ শর্তাবলীসহ যোগ্যতাসম্পন্ন বিদ্বান। অনুবাদক

[3] সহীহ হাদীস বলে: যে হাদীসের বর্ণনাসূত্র অবিচ্ছিন্ন, বর্ণনাকারীগণ আদেল তথা বিশেষ চারিত্রিক গুণে গুনান্বিত, হাদীস গ্রহণ, স্মরণ ও সংরক্ষণে পূর্ণ দক্ষতা সম্পন্ন, সহীহ হওয়ার পরিপন্থী সর্বপ্রকার সূক্ষ্ণ দোষ-ত্রুটি মুক্ত ও অন্য কোন সহীহ হাদীসের বিপরীত না। মোট কথা যে হাদীস নবী (সা.) থেকে সুসাব্যস্ত ও আমলের যোগ। অনুবাদক

[4] হাসান হাদীস বলে: যে হাদীসের কোন বর্ণনাকারী উপরোক্ত সহীহ হাদীসের গুণাবলির মধ্যে শুধুমাত্র হাদীস গ্রহণ, স্মরণ ও সংরক্ষণে একটু দুর্বল। এ হাদীসও আমলোর যোগ্য। অনুবাদক